Sunday, June 22, 2014

"মনের আকাশের জ্যেষ্ঠ তাঁরকা"

আমাদের কন্যা সাগুপ্তা আফরিন ভূঁইয়া "উর্নিষা" এই বছর উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনীর পাঠ্যক্রম সমাপনী উপলক্ষে তাকে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি ও আবেগ নিয়ে এই লেখাটিঃ-

"মনের আকাশের জ্যেষ্ঠ তাঁরকা"
মিজানুর ভূঁইয়া
 
আজ আমার মনের ভিতর কি যেনো এক
অদ্ভুত সুখানাভুতি আমাকে বার বার শিহরিত করছে!
জীবনের মহান প্রাপ্তিলগ্নে একটি মানুষের মনের কুঠরে
আনন্দের যে স্ফুলিঙ্গ ধারা ক্রমাগত প্রবাহিত হতে থাকে,
ঠিক তেমনি একটা কিছু আজ আমার মনের আকাশ
ছুঁই ছুঁই করছে। আজ আমার মন গগনে সহস্র তাঁরকা
রাশির মাঝে ভর-পূর্নিমার উজ্জল চাঁদের উপস্থিতি টের পাচ্ছি।
জীবনের হাজার অন্ধকার রজনী অতিক্রম করা একটি
টলটলে সম্ভাবনাময় সোনালী সূর্য্য এক বিশাল প্রতিশ্রুতি নিয়ে
আমার হৃদয়ের এক প্রান্তে প্রজ্জলমান হয়ে উদিত হয়েছে।
তেমনিতর অপূর্ব সব সুখস্ফুলিঙ্গ হৃদয় অলিন্দের চারপাশে
আলিঙ্গন করছে, যা আমি গভীরভাবে অনুভব করছি।
আজ আমার সত্যই মনে হচ্ছে আমার একহাতের মুঠোয় চাঁদ,
অন্য হাতের মুঠোয় সূর্য্য আর বুকের ভিতর এক বিশাল আকাশ।
আজ থেকে ঠিক আঠার বছর আগে যেদিন আমি প্রথম দেখলাম 
একটি চাঁদ এসেছে আমার ঘরে, আমার এবং আমাদেরই হয়ে
সেদিনও আমার মনে একই রকম আনন্দ শিহরণ স্পর্শ করেছিল,
এক অপূর্ব আলোকবর্তিকায়, সে আমার দেহের ভিতরের এক
মহাআবিস্কার, আমার ঐরশ থেকে জন্ম নেয়া এক মানবী,
আমার এবং আমাদের প্রিয়তম কন্ন্যা; উর্নিষা।
উর্নিষা নামটি রাখার পিছনে দুটি তাৎপর্য ছিল, প্রতমতঃ
একই সময়ে একই হসপিটালে জন্ম নিয়েছিল আমার মেঝো
ভাইয়ের কন্যা উষা; উষার বড় বোনের নাম ছিল উর্মি।
আর যেহেতু সবক'টি নামই গ্রহ নক্ষত্র ও প্রকৃতি বিষয়ক;
তাই আমাদের কন্যার নামটিও হয়ে গেল উর্নিষা।
এটি একটি নক্ষত্রমন্ডলের অতিউজ্জলতর তাঁরকার নাম।
আজ আমি সত্যই ধন্য; সেই তাঁরকাটি জ্বলে উঠেছে
আপন আলোকবর্তিকায়; আপন মহিমায়, আমাদের স্বপ্ন আকাশে।    
আর শাগুপ্তা আফরিন নামটি; সে আমার ভাললাগা একটি নাম।
এসব কিছুর পরও; ওর আরেকটি নাম আছে যা বাইরের
জগতের কেউই জানেনা; সেটা হলো তার প্রতি আমার হৃদয়
নিসৃত অতিআবেগ ও ভালবাসা বহিঃপ্রকাশের শাব্দিক প্রকাশ।  
আর সেই কারণেই তার তৃতীয় নামটি হয়েছিল "বাবন" 
আমাদের সেই ছোট্র পুতুলরুপি বাবন আজ অনেক বড় হয়েছে।       
আজ তুই অস্টাদশী; দ্বাদশ শ্রেনীর পাঠ শেষ করে পা রাখছিস
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ শেষে কর্মজীবন,
এর পর; ধাপে ধাপে জীবনচক্রের সবকটি শিড়ি অতিক্রম করা। 
আজ এই মহালগ্নে আবেগমাখা স্মৃতিগুলো আমাকে টেনে নিয়ে যায়
সেই দূর অতীতে; যেদিন হসপিটালের লেবার রুম থেকে হঠাৎ
মানব শিশুর ক্রন্দনরত   চিৎকার থেমে থেমে আমার কানে
ভেসে আসছিল; আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছিলামনা;
আদৌ কি হতে যাচ্ছে! খানিক পরেই দেখলাম আমার বড় বোন,
তোর বড় ফুফি স্বহাস্যে আমার সামনে এসে দাড়ালো।
আর বললো; তুই একটি কন্যার বাবা হয়েছিসরে ভাই;
তোর ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি মেয়ে হয়েছে,
সে দেখতে একদম অবিকল আমাদের মায়ের মত চেহারা।   
এক্ষুনি গিয়ে মধু নিয়ে আয়; নতুন অতিথির মুখে মধু দিয়ে
বরণ করতে হয়; আমি তখন আনন্দে হাসবো না কাঁধবো
ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলামনা! একেবারে হতবিহবল হয়ে
এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছিলাম ; ছুটে চললাম মধু সংগ্রহে।
তাড়াহুড়ো করে রিক্সায় চড়ে বসলাম, শান্তিনগর চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে।
দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো; স্যার, দেশী মধু ১২০ টাকা
আর অস্ট্রেলিয়ান মধুর দাম হবে ২৬৫ টাকা; বিদেশিটা খুব ভাল।
দামে তখন কি আসে যায় আমার; দামী মধুই কিনে নিলাম। 
জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটি যখন আমার ঘরে; এর চেয়ে
আর কিই-বা এতো বেশি মূল্যবান হতে পারে আমার জীবনে!   
আবার চড়ে বসলাম রিক্সায়; যেন আর তর সইছিলনা আমার
কখন গিয়ে পৌছাবো, রিক্সাওয়ালাকে তাগিদ দিচ্ছিলাম; জলদি চালাও।
রিক্সাওয়ালার উত্তর; আর কতো জোরে চালামু ; স্যার।     
অস্ট্রেলিয়ান মধু মুখে দিয়ে সেই তোকে বরণ করেছিলাম; বাবন 
জীবনের সেই স্মৃতিটুকু আজও আমাকে বার বার আপ্লুত করে।
প্রথম সন্তানের পিতা হওয়ার যে হৃদয় ভরা আত্মতৃপ্তি ও গৌরব 
সেই অহংকার আজও আমার মনকে প্রচন্ডভাবে পুলকিত করে।  
যেদিন আমরা প্রথম আমেরিকা আসার ভিসা পেলাম, আমার মনটি
আর দশজনের মতো খুশিতে নেচে উঠেনী; বরং খুবই ভারাক্রান্ত ছিল।  
কারণ: নিজ দেশ ত্যাগ করা আমার কোনো কালেরই ব্রত ছিলনা।
তিন মাস ধরে নিজের মনের সাথে আমি অসংখ্য বার যুদ্ধ করেছি
অবশেষে নিজের অজান্তেই হেরে গেলাম; হলাম দেশত্যাগী।
এই ভেবেই যে; একদিন যখন এই ছোট্র শিশুটি জানতে পারবে 
স্বপ্ন রাজ্যে যাওয়ার সেই সুযোগটি আমি প্রত্যাখ্যান করেছি; এবং
যার ফলশ্রুতিতে শিশুটিও একইভাবে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে   
সেই অপরাধবোধ থেকে নিজের সাথে আমি আত্মসমর্পণ করেছি।
আমি স্ত্রী আর বাবন; আমরা তিনজনে মিলে শুরু হলো প্রবাস জীবন।
যেদিন প্রথম ফ্লোরিডায় মিয়ামী বিমান বন্ধরে এসে পৌছলাম;
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বন্ধু ফারুককে যখন দেখতে পেলামনা।
আমার সমস্ত ঠোট, মুখ এবং গলা অবদি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।
হঠাৎ ক্ষানিক পরে এক ঝলক আলোর মত স্কুল বন্ধু অমর ফারুক
আমাদের সামনে এসে দাড়ালো; বিদেশের এটিই প্রথম অভিজ্ঞতা।
মায়ামীতে দুই সপ্তাহ থাকার পর চলে এলাম ওয়াশিংট এলাকাতে।
শুরু হলো নতুন আরেক জীবন যুদ্ধ; নিজের স্কুল, চাকরী আর
মেয়েকে দিনের বেলা দেখাশুনা করা, একেবারে জীবনের কঠিন রূপ।  
সংসার চালানোর জন্য আমাদের দুজনকেই কাজ করতে হতো
তাই পালাক্রমে দুজনেই এক বেলা কাজ করা, অন্য বেলা মেয়েকে
দেখাশুনা করা, এভাবেই দিনে দিনে বড় হয়েছে আমাদের বাবন।                 
আমাদের বাবন আজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিয্যকে ধারণ করে
সত্যিই আমাদের নিজ মনে লালিত আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে।   
আমার মনের ভিতর পোষা সাদা পায়রাগুলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর 
আজ অনেক হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে; এখন শুধু নিজ ডানায় ভর করে
মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবার প্রতীক্ষায়। নিজেকে আবিস্কার করার
সোনালী সোপানের মাহেন্দ্র ক্ষণে উপনীত; স্বপ্নের সেই সূর্য্যটি এখন
অতি সন্নিকটে; শুধু দু'হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করা মাত্র।     
পায়রাগুলো এবার একটি একটি করে খোলা আকাশে উড়ে বেড়াবে
শান্তির অমোখ বার্তা নিয়ে; মুক্ত বিহঙ্গের মতো সারা দুনিয়াময়।
শান্তির প্রতীক হয়ে ছড়াবে মানব হৃদয়ে চির প্রশান্তির অম্লান ধারা
জ্বলে উঠবে চির উজ্জল হয়ে আমার মনের আকাশের জ্যেষ্ঠ তাঁরকা।
ছড়াবে আলো ভুবনময়, আপন মহিমায় ঘুছাবে সকল অন্ধকার
ভালবাসার অমিয় ধারায় অভিষিক্ত করিবে জগৎ সংসারময়।
শান্তির বর্ষণে ধুয়ে মুছে নিবে; আছে যত পাপ ও অন্যায়
এভাবেই জ্যেষ্ঠ তাঁরকা জাগিয়া রহিবে আমার সারা অন্তরময়।
===============================================  
রচনা:- ২৯ মে থেকে ১৮ই জুন
ভার্জিনিয়া, ইউ এস এ
লেখকের একক সর্বসত্ত্বাধিকার সংরক্ষিত।

No comments:

Post a Comment