Sunday, December 10, 2017

"বাংলাদেশ রেলওয়ে ও কিছু স্মৃতি"

"বাংলাদেশ রেলওয়ে ও কিছু স্মৃতি"
মিজানুর ভূইয়াঁ

সেই ছোট্ট বেলায় বাবা মায়ের সাথে
ট্রেনে চড়ে কোথা থেকে কোথায় যে
চলে যেতাম তার কোনো শেষ ছিলোনা ।
বাবা ছিলেন রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী,
কিছুদিন এখানে আবার কিছুদিন ওখানে
এমনিকরে সমগ্র বাংলাদেশের
প্রায় সব ক’টি রেল সংযোগ আছে এবং
রেলওয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা আছে
সেসকল জেলা এবং উপশহরে আমাদের
থাকতে সবাইকে হয়েছিল।

আর তাই আমাদের বড় ভাই বোন
প্রায় সবারই লেখাপড়া তৎসংলগ্ন রেলওয়ে স্কুলে
এবং সেখানকার কলেজে করতে হয়েছিল।
শুধু আমি এবং আমার একটি ছোট ভাই
এবং একটি ছোট বোন কুমিল্লা ও ঢাকাতে
লেখাপড়া করেছিলাম।

রেলগাড়িতে চড়ে যখন এদিক সেদিক বেড়াতে
যেতাম অথবা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম।
কখনো এমনি হতো রাতের বেলায় রেলগাড়ি
ঝমঝম আওয়াজ করে হেলে দুলে
গভীর অন্ধকারকে ভেদ করে চলছেতো চলছে
যার কোনোই শেষ ছিলনা এমন মনে হতো।

বাহিরে বাতাসের শনশন শব্দে সারা মনে
এক অপূর্ব দোলা দিয়ে যেতো।
জানালা দিয়ে বাহিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার
মজাই ছিল এক অন্যরকম সুখের ব্যাপার।
মনে হতো দূরের বাড়ি ঘর আর সবুজ গাছগুলো
যেনো চলন্ত গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে
একই সমান গতিতে ছুটে চলছে; কি অদ্ভুত সেই আনন্দ।

স্টেশনে গাড়ি এসে থামলেই ফেরিওয়ালাদের
নানা শুরে চীনাবাদাম, বাখরখানি আর চা গরম
শব্ধগুলো আজও কানের কাছে কতো প্রিয় হয়ে বাজে ।
বিশাল নদী পার হওয়া সেতু সেতো ছিল
অনেক দুঃসাহসী আনন্দের অপূর্ব এক অভিজ্ঞতা। 
    
আবার কখনো কখনো গাড়ির হেলেদুলে চলার
ঝাকুনিতে শরীরে অনেক ক্লান্তি এবং অবসাদ
নেমে আসতো আর তারই ফাঁকে
কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম টেরই পেতাম না। 
হঠাৎ করে একতারা খঞ্জর, ডুগডুগি আর ভাওয়াইয়া
এবং মুর্শিদী গানের আওয়াজ যখন কানে এসে পৌছতো,
একেবারে হুড়মুড় করে জেগে জেগে উঠতাম।
আর জেগেই দেখতে পেতাম গেরুয়া পোশাক পরা কিছু লোকজন
জীবিকা নির্বাহের অবল্বন হিসাবে অনবরত গেয়েই যাচ্ছেন।
এই রকম দৃশ্যগুলো বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গ কিংবা
সিলেটে যাওয়া আসার পথেই বেশি দেখা যেতো।

জীবনের সেই মৌলিক আনন্দের সময়গুলোকে
এই জীবনে কখনোই ভুলার মতো নয়।
বাল্যকালের সকল কিছুতেই যেন জীবনের সব চেয়ে
সরস এবং নির্ভেজাল আনন্দ লুকিয়ে থাকে।
সেই সময়গুলোর যে সুখ এবং আনন্দ 
এর সাথে জীবনের আর কোনো কিছুর সাথে
তেমন কিছুকে মিলানো যায়না।

আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়িতাম একবার
মায়ের সাথে রাগ করে পালিয়ে বাবার কাছে
যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম,
বাবা তখন সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জে থাকতেন।
বাড়ি থেকে পালিয়ে বেরুনোর কারণে
আমার গায়ে যে ময়লা জামাটি পরা ছিলো
সেটা পরেই কুমিল্লা রেলস্টেশনে গিয়ে
একেবারে রোজকার মতো প্রথম শ্রেণীতে
গিয়ে চড়ে বসলাম , এদিকেতো ভয়ে গলা শুকিয়ে
একেবারে কাঠ, কারণ বাবাতো সাথে নেই
আর টিকেটওতো করা হয়নি, যদি ধরা পড়ি।

যেতে যেতে ট্রেন যখন আখাউড়া স্টেশনে গিয়ে থামলো
এখন আমাকে সিলেটগামী ট্রেনে চড়তে হবে।
যেই না নামবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি;
আর অমনি টিটি বাবু এসে ধরে বলছে
এই বাবু কোথা যাচ্ছো, সাথে টিকেট আছে?
আমিতো একেবারে ভয়ে জড়সড়।
হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি এলো,
বলে ফেললাম আমি আই ডব্লিউ মনিরুদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে।
টিটি বাবু কয়েকবার আমার পোশাক আশাকের
দিকে তাকিয়ে একটু যদিও সন্ধিহান ছিলেন
অবশেষে বললেন ও তুমি ইঞ্জিনিয়ার
মনিরুদ্দিন সাহেবের ছেলে, ঠিক আছে।

যাক বাঁচা গেলো এবার, একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
চুপ করে বসে থাকলাম আর বাবার এই সুখ্যাতি
এবং পরিচিতি দেখে মনে মনে নিজেকে
খুবই সৌভাগ্যবান মনে করলাম।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সাথে আমাদের জীবনের
এমনিতর হাজার ঘটনা আছে যা আজও
নিজের মনের কোণে স্মৃতি হয়ে নাড়া দেয়।
আজ যখন নিজের ছেলে মেয়েদেরকে
সেই গল্প বলি নিজের অজান্তেই
যেন কোথায় হারিয়ে যাই, নিজেই তা বুঝিনা।

আমি নিজেও আমেরিকা আসার পর বার বছর
এয়ারলাইনে কাজ করার সুবাদে
নিজের পরিবার ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে
পৃথিবীর অনেক দেশেই ভ্রমণ করার সুযোগ
হয়েছিল আর জীবনে কতইনা আনন্দ করেছি।
জীবনের কোন একদিন ছেলে মেয়েরাও হয়তো
আমার মতো এমনি করে জীবনের সেই সুন্দর
স্মৃতিগুলোকে খতিয়ে খতিয়ে দেখবে।
আর নিজের শৈশবকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করবে।।

চলবে.........
===========================
 ১১ ডিসেম্বর ২০১৭
ভার্জিনিয়া ইউ এস এ        

No comments:

Post a Comment